রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে জন্ডিস দেখা দেয়।বিলিরুবিন হল একটি হলুদ রঙ্গক যা যকৃতে উৎপন্ন হয় যখন লোহিত রক্তকণিকা ভেঙ্গে যায়। বিলিরুবিন তৈরি হয় লোহিত রক্তকণিকা থেকে। রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙ্গে গিয়ে বিলিরুবিনে পরিণত হয়। যা লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়ে পিত্ত রসের সাথে পিত্তনালীর মাধ্যমে পরিপাকতন্ত্রে পৌঁছায়। অন্ত্র থেকে বিলিরুবিন নিষ্কাশনের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে আসে। এই প্রক্রিয়ায় কোনরূপ অসঙ্গতি দেখা দিলে রক্তে বিলিরুবিন বেড়ে যায় এবং সৃষ্টি হয় জন্ডিসের।
রক্তে বিলিরুবিনের ঘনত্ব 3 mg/dL বা 50 µmol/L এর বেশি হলে জন্ডিস হয়। জন্ডিস রোগ এ আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর সারা বিশ্বে অনেক মানুষ মারা যায়। লিভার শরীরের জন্য বিভিন্ন ধরণের কাজ করে সেজন্য লিভার শরীরের একমাত্র অঙ্গ। লিভারের অনেক প্রকার রোগ দেখা দেয়, তার মধ্যে জন্ডিস হচ্ছে সু-পরিচিত এক ধরণের হেপাটাইটিস।
জন্ডিস কি
শরীর ও ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়াকে সাধারণত জন্ডিস ধরা হয়। জন্ডিসের ফলে ত্বক, চোখের সাদা অংশ, মিউকাস মেমব্রেন এবং শরীরের অন্যান্য টিস্যু হলুদ হয়ে যায়। জন্ডিস কোন রোগ নয় এটি সাধারণত রোগের উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যকৃতে সমস্যার কারণে জন্ডিস দেখা দেয়। আমাদের শরীরের লোহিত কণিকাগুলি নির্দিষ্ট সময় পরে নষ্ট হয়ে যায় এবং লোহিত কনিকা তখন বিলিরুবিন তৈরি করে। যকৃতে বিলিরুবিন পিত্তে রূপান্তরিত হয় এবং তারপর এটি পয়নিষ্কাশনের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। আর এটি বের না হলে শরিলে জন্ডিস হয়েছে বলে ধরা হয়।
জন্ডিসের প্রকারভেদ
জন্ডিস প্রধানত তিন প্রকারের হয়ে থাকে। যথা :
১. প্রি হেপাটিক: লোহিত রক্তকণিকা লিভারে পৌঁছানোর আগেই যদি ভেঙ্গে যায়। ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে লোহিত রক্ত কণিকার জন্য বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যায়।
২. হেপাটো সেলুলার: লিভারের সমস্যা হলে বিলিরুবিন প্রক্রিয়াকরণ এবং কার্যকরভাবে নিষ্কাশন করার ক্ষমতাকে ব্যাহত করে।
৩. পোস্ট হেপাটিক: সাধারণত পিত্ত থলিতে বাধা থাকলে এই ধরনের জন্ডিস হয়ে থাকে। লিভার থেকে অন্ত্রে পিত্তের স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধা দেয় যার রক্ত প্রবাহে বিলিরুবিন জমা করে থাকে।
জন্ডিসের কেন হয়
জন্ডিস হয় যখন বিলিরুবিন নামক পদার্থ শরীরের রক্ত এবং টিস্যুতে জমা হয়। লোহিত রক্তকণিকা ভাঙ্গনের ফলে বিলিরুবিন উৎপাদিত হয়।বিভিন্ন কারণে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। যেমন লোহিত রক্তকণিকার অতিরিক্ত ভেঙে যাওয়া, বিলিরুবিনের বিপাকজনিত নানা সমস্যা, পিত্তরস লিভার থেকে ক্ষুদ্রান্ত্রে যাওয়ার পথে বাধা পেলে ইত্যাদি।নিন্মে জন্ডিসের কারণগুলো উল্লেখ করা হলো:
- ম্যালেরিয়ার রোগের জন্য।
- সিকেল সেল অ্যানিমিয়া। এটি একটি জিনগত রোগ। যা দ্রুত লোহিত রক্তকণিকা ভেঙ্গে ফেলে।
- অটোইমিউন ডিসঅর্ডার।এ রোগের ফলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম লোহিত কণিকা ভেঙ্গে ফেলে।
- লিভার সিরোসিস।দীর্ঘদিন এখনো জাতীয় খাবার খেলে এবার নষ্ট হয়ে যায় তখন লোহিত রক্তকণিকা দ্রুত ভেঙে যায়।
- লিবারে টিউমার বা ক্যান্সার হলে লিভারের কার্যকারিতা হ্রাস পায়।
- লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমে গেলে লোহিত রক্তকণিকা দ্রুত ভেঙ্গে যায়।
- গলব্লাডারে পাথর জমলে পিত্তনালী বন্ধ হয়ে সেখানে বিলিরুবিন জমতে থাকে।
- হিমোলাইটিক অ্যানেমিয়া, যেমন থ্যালাসেমিয়া।
- ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে অনেক সময় রক্তকণিকা ভেঙে যায় দ্রুত।
- পিত্তনালীর প্রদাহে বিলিরুবিন শোষণ ব্যাহত হয়। ফলে বিলিরুবিন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
- জেনেটিক রোগ।
- ক্যানসার (প্যানক্রিয়াস, লিভার, পিত্তনালি ও পিত্তথলি, খাদ্যনালি)।
- ভাইরাস: হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস এ, হেপাটাইটিস ই, হেপাটাইটিস সি ইত্যাদি।এটি ভাইরাসজনিত লিভার সংক্রমক।
উল্লিখিত কারন ছাড়াও অনেক অপ্রচলিত ও বিরল রোগেও জন্ডিস উপসর্গটি দেখা দেয়।
জন্ডিসের লক্ষণ
জন্ডিস রোগের বিভিন্ন উপসর্গ রয়েছে। জন্ডিস রোগের লক্ষণ আমরা শরীলের বাহ্যিক পরিবর্তনের ফলে লক্ষ্য করতে পারি। নিম্মে জন্ডিস রোগের লক্ষণগুলো উল্লেখ্য করা হলো।
১. ত্বক এবং চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া
২. ক্লান্তি ও দুর্বলতা।
৩. গাঢ় রঙের প্রস্রাব।
৪. চুলকানি।
৫. বমির আশঙ্কা।
৬. অরুচি ও ওজন কমে যাওয়া।
৭. মৃদু বা তীব্র পেটে ব্যথা।
৮. প্রচন্ড জ্বর ও শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
৯. কাঁপনি দিয়ে জ্বর আসা।
১০. শরীর ফুলে যাওয়া।
জন্ডিসের প্রতিকার
• শরীর থেকে টক্সিন বের করে দিতে এবং প্রতিরোধ করতে প্রচুর পানি পান করতে হবে।
• হেপাটাইটিস এ, বি ভাইরাসের টিকা প্রদান করতে হবে।
• শরীরের রক্ত নেওয়ার প্রয়োজন হলে স্ক্রীনিং করে নিতে হবে।
• অ্যালকোহল বা নেশা জাতীয় দ্রব্য পরিহার করতে হবে।
• নিরাপদ যৌনমিলন।
• সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
• লিভারের চর্বি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
• সর্বদা হাইড্রেড থাকতে হবে।
• স্বাস্থ্যকর খাবার ফল, সবজি এবং চর্বিহীন প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।
• চর্বিযুক্ত, প্রক্রিয়াজাত এবং ভাজা খাবার এড়িয়ে এবং আপনার অ্যালকোহল এবং চিনিযুক্ত পানীয় গ্রহণ বাদ দিতে হবে।
• পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিতে হবে যাতে লিভারের উপর কোন চাপ না পরে।
• ভিটামিন সি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা লিভারকে ফ্রি র্যাডিক্যালের কারণে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে।ভিটামিন সি জাতীয় খাবার বেশি বেশি খেতে হবে।
• ভেষজ চা: কিছু ভেষজ চা, যেমন ড্যান্ডেলিয়ন রুট চা, লিভারের স্বাস্থ্যকে সমর্থন করতে এবং পিত্ত প্রবাহকে উন্নত করতে সহায়তা করতে পারে। আপনার রুটিনে ভেষজ প্রতিকার অন্তর্ভুক্ত করার আগে একজন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে পরামর্শ করুন, বিশেষ করে যদি আপনার অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্যের অবস্থা থাকে বা ওষুধ সেবন করেন।
• খাবারে হলুদের পরিমাণ বাড়াতে হবে কারণ হলুদ লিভারের জন্য খুবই উপকারী একটি উপাদান।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
শেষ কথা
জন্ডিস কোন প্রকার রোগ নয় সেহেতু কোন প্রকার ঔষধ সেবনের প্রয়োজন নাই। একমাসের মধ্যে বিলিরুবিনের মাত্রা সঠিক নিয়ন্ত্রণে চলে আসলে জন্ডিস স্বাভাবিক ভাবে ভালো হয়ে যায়। জন্ডিস ভালো হওয়ার জন্য বিশ্রামেই একমাত্র চিকিৎসা। আশা করতেছি আমাদের এই আর্টিকেল থেকে জন্ডিস এর লক্ষণ কি, কেন হয়, প্রকারভেদ, প্রতিকার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। যদি আর্টিকেল আপনাদের কাছে ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনার আশেপাশের ব্যক্তিদেরকে শেয়ার করে জানিয়ে দিবেন। ধন্যবাদ