আইবিএস(IBS) থেকে দ্রুত মুক্তির উপায় এবং আধুনিক চিকিৎসা

আইবিএস(Irritable Bowel Syndrome) পেটের একটি পরিচিত ও বিরক্তিকর সমস্যা। ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম হচ্ছে পরিপাকতন্ত্রের ফাংশনাল সমস্যা। এখানে পরিপাকতন্ত্রের গঠনগত কোন পরিবর্তন হয় না। আইবিএস মানুষের মধ্যে অপ্রত্যাশিত ভয়ের সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, কোথাও যাওয়ার আগে এ সমস্যায় আক্রান্ত রোগীরা কোথায় টয়লেট আছে তার খোঁজ নেন। কখনো কখনো খাবার গ্রহণের পরপরই তাঁদের পেটে মলত্যাগের তাড়না সৃষ্টি হয়, যা প্রায়ই তাঁদের একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। তাই এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত উদ্বেগ এবং আতঙ্ক অনুভব করেন।

এটি সাধারণত পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং গ্যাসের মতো উপসর্গ সৃষ্টি করে। পুরুষদের তুলনায় নারীরাই আইবিএসে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। পাশ্চাত্য দেশে প্রতি ১০ জনে অন্তত একজন মানুষ এ রোগে তার জীবদ্দশায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, প্রতি ১০০ জন পুরুষে ২০ দশমিক ৬ জন এবং ১০০ জন নারীর মধ্যে ২৭ দশমিক ৭ জন এ রোগে আক্রান্ত হন।

আইবিএস(IBS) কি?

আইবিএস হলো অন্ত্রের এমন একটি সমস্যা যেখানে হজম প্রক্রিয়া ঠিকমতো কাজ করে না, যার ফলে পেটে ব্যথা, গ্যাস, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণভাবে অনেকে আইবিএসকে পুরাতন আমাশয়ও বলে থাকেন। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা এবং প্রায়ই এটি বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপ এবং খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।

আইবিএস(IBS) কেন হয়?

আইবিএস (Irritable Bowel Syndrome) কেন হয় তা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি, তবে কিছু নির্দিষ্ট কারণ লক্ষণগুলি বাড়িয়ে তুলতে পারে। সাধারণভাবে, খাদ্যনালির অতিসংবেদনশীলতা, অন্ত্রের চলাচলের অস্বাভাবিকতা বা মস্তিষ্কে বার্তা পরিবহণের সময় ত্রুটি এই রোগের লক্ষণগুলির সূচনা করে। এছাড়াও অত্যাধিক মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও দুঃশ্চিন্তা, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, হরমোন (নারীদের মাসিকচক্রের সঙ্গে), পরিপাকতন্ত্রের অস্বাভাবিক সংকোচন ও প্রসারণ, পরিপাকতন্ত্রের অতি সংবেদনশীলতা, পরিপাকতন্ত্রে উপকারি ও অপকারি ব্যাকটেরিয়ার অসামঞ্জস্যতা এবং বংশগত কারণও আইবিএস-এর কারণ হতে পারে। এর পাশাপাশি, মাদক সেবন, দীর্ঘমেয়াদী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে এবং পেটের অপারেশনের পরে এই রোগের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

আইবিএস(IBS) এর উপসর্গসমুহ

আইবিএসের উপসর্গসমুহ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। আইবিএস এর রোগীরা সাধারণত কিছু উপসর্গ অনুভব করেন। এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:

  • পেট ব্যথা বা অস্বস্তি।
  • গ্যাস এবং পেট ফাঁপা।
  • ডায়রিয়া এবং কোষ্ঠকাঠিন্য।
  • বারবার বাথরুম যাওয়ার প্রবণতা।
  • নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক চলাকালীন কিংবা মিলনের সময় ব্যথা।
  • পেটে ব্যথা হলে টয়লেটে যাওয়ার খুব তাড়া এবং পাতলা পায়খানা হওয়া।

কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়

আইবিএস নির্ণয়ের জন্য কোনও নির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। তবে রোগীদের কাছ থেকে রোগের ইতিহাস শুনে ও লক্ষণ দেখে এই রোগ নির্ণয় করতে হয়। আইবিএস নির্ণয়ের জন্য বর্তমানে Rome IV ক্রাইটেরিয়া সর্বাধিক প্রচলিত। এই রোগ দুই রকম হতে পারে, যেমন আইবিএস ডি, যা পাতলা বা নরম পায়খানার সঙ্গে পেটে ব্যথার সৃষ্টি করে এবং আইবিএস সি, যেখানে কোষ্ঠকাঠিন্যের সাথে পেটের ব্যথা অনুভূত হয়। এছাড়া, কিছু লোকের ক্ষেত্রে আইবিএস ডি এবং আইবিএস সি উভয় ধরনের লক্ষণ থাকতে পারে যেমন- পাতলা পায়খানা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য। এটাকে বলা হয় আইবিএস এম

আইবিএস(IBS) থেকে মুক্তির উপায়

আইবিএস পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য নয়, তবে কিছু পদক্ষেপ অনুসরণ করলে এর উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

  • নির্ধারিত সময়ে খাবার খাওয়া।
  • সবজি, বিশেষ করে লিক ভেজিটেবল খাওয়া।
  • সারা দিনে অল্প অল্প করে ভাগ করে খাবার খাওয়া।
  • চর্বি যুক্ত খাবার কম খাওয়া।
  • প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা।
  • মানসিক চাপ কমাতে ধ্যান ও নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস করা।
  • দুধ ও দুধের তৈরি খাবার, শাক পাতা, অতিরিক্ত মসলাযুক্ত, তেলে ভাজা ও ডিপ ফ্রাই খাবার পরিহার করা।
  • মুক্ত বাতাসে নিয়মিত হাঁটাচলা, মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম করা, এতে পেটের গ্যাস ভাব কমে।
  • অতিরিক্ত ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা।
  • স্পেশালিষ্ট দ্বারা আইবিএস রোগীর খাবার তালিকা মেনে চলা।

আইবিএস (IBS) এর আধুনিক চিকিৎসা

আইবিএস (IBS) এর আধুনিক চিকিৎসায় লিক ভেজিটেবল এবং ওজোন সাওনা থেরাপি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। লিক ভেজিটেবল প্রোবায়োটিক এবং দ্রবণীয় ফাইবারের একটি উত্তম উৎস, যা অন্ত্রের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পুষ্টি সরবরাহ করে, পেটের প্রদাহ হ্রাস করতে সাহায্য করে এবং হজম প্রক্রিয়াকে সহজতর করে। নিয়মিত ব্যবহার করলে আইবিএস এর সমস্যাগুলো অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

অন্যদিকে, ওজোন সাওনা থেরাপি শরীরের টিস্যুতে অক্সিজেন প্রবাহ বৃদ্ধি করে এবং রক্ত সঞ্চালনকে ত্বরান্বিত করে, যা আইবিএস রোগ প্রতিরোধের জন্য সহায়ক। এটি একটি নিরাপদ এবং চেতনা সৃষ্টিকারী চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে।

ঘরোয়া প্রতিকার

কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হিসেবে কলা, পেঁপে এবং পেয়ারা কিছুটা সাহায্য করতে পারে। এছাড়া, আকুপ্রেশার পদ্ধতির মাধ্যমে অন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। যোগব্যায়াম, মালিশ বা ম্যাসাজ এবং ধ্যানের নিয়মিত চর্চা মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক হতে পারে। আইবিএস এর ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকারের ল্যাক্সেটিভ জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ইসবগুলের ভুসি এবং অন্যান্য আঁশজাতীয় পানীয়ও এই সমস্যা সামাধানে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। আদা চা ও পুদিনার চা পান করা কারণ আদা হজমে সহায়ক ও পেট ব্যথা কমাতে পারে এবং এটি কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে।

আইবিএস(IBS) সংক্রান্ত জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)

প্রশ্ন: আইবিএস পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য কি?
উত্তর: না, আইবিএস পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য নয়, তবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা মেনে চললে এর উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

প্রশ্ন: আইবিএস এর উপসর্গ কখন খারাপের দিকে যেতে পারে?
উত্তর: মানসিক চাপ এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস আইবিএস-এর উপসর্গ খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

প্রশ্ন: আইবিএস হলে কী ধরনের খাবার এড়িয়ে চলা উচিত?
উত্তর: মসলাযুক্ত খাবার, ক্যাফেইন, চকলেট এবং ডেইরি প্রোডাক্ট এড়িয়ে চলা উচিত।

প্রশ্ন: আইবিএস এর জন্য প্রোবায়োটিক কতটা কার্যকর?
উত্তর: প্রোবায়োটিক অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া ব্যালান্স বজায় রাখতে সহায়ক এবং আইবিএস এর উপসর্গ কমাতে কার্যকর।

প্রশ্ন: আইবিএস হলে স্ট্রেস কমানোর জন্য কী করা উচিত?
উত্তর: ধ্যান, যোগব্যায়াম এবং নিয়মিত ব্যায়াম স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে, যা আইবিএস এর উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top