ব্লাড ক্যানসার কেন হয় তার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নাই। তবে কিছু কিছু বিষয় ব্লাড ক্যানসারের পরিমাণটা বাড়িয়ে দেয়। যেমন- রেডিয়েশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল, কীটনাশক বা পেস্টিসাইড, ভেজাল খাবার, কেমোথেরাপি ড্রাগস ও কিছু জেনেটিক অসুখ দায়ী থাকতে পারে।
উপরোক্ত যে কোনো কারণে অস্থিমজ্জার ভেতরের স্টেমসেল (মাদার সেল)-এর মিউটেশন বা অন্য কোনো পরিবর্তন হলে ক্যানসার সেল (ব্লাস্ট) বা অপরিপক্ব কোষ তৈরি হয়, যা অস্থিমজ্জার ভেতরে অতিদ্রুত বৃদ্ধি হয়। যে কোনো বয়সে, যে কোনো জেন্ডারেরই লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা হতে পারে।
নানাভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের জিনের মধ্যে বা ক্রোমোজোমের ভেতরে মিউটেশন হতে থাকে। এ মিউটেশন যদি সঠিকভাবে কাজ না করে এবং এটা যদি স্থায়ী হয়ে যায়, তাহলে শরীরের মধ্যে যে অনকজিন নামের একটা জিন রয়েছে, সেটা অ্যাক্টিভেটেড হলে, তখন যে কোনো কোষের ব্লাড ক্যানসারে রূপান্তরিত হতে পারে। যেমন- আমরা বলতে পারি ডাউন সিনড্রোম যাদের হয়, তাদের এ ব্লাড ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
ব্লাড ক্যান্সার কি
ব্লাড ক্যান্সার এমন একটি রোগ যা রক্তের কণিকা তৈরি এবং তাদের কাজ করার প্রক্রিয়ায় সমস্যা তৈরি করে। এই ক্যান্সার সাধারণত হাড়ের মজ্জায় শুরু হয়, যা দেহের বিভিন্ন ধরনের রক্ত কণিকা যেমন লাল রক্ত কণিকা, সাদা রক্ত কণিকা এবং প্লেটলেট উৎপাদন করে। এই কণিকাগুলো দেহে অক্সিজেন সরবরাহ, সংক্রমণ প্রতিরোধ, এবং রক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্লাড ক্যান্সার হলে অস্বাভাবিক কণিকাগুলো স্বাভাবিক রক্ত কণিকার উপর প্রভাব ফেলে, যার ফলে দেহের বিভিন্ন সিস্টেম বিপর্যস্ত হয়।
ব্লাড ক্যান্সারের ধরনসমূহ
ব্লাড ক্যান্সারের মূলত তিনটি প্রধান ধরন রয়েছে এবং প্রত্যেকটির বেশ কিছু উপধরন রয়েছে। এগুলো হলো:
১. লিউকেমিয়া: এটি হাড়ের মজ্জায় শুরু হয়ে রক্তের শ্বেত রক্তকণিকাগুলোর অসংযত বৃদ্ধি ঘটায়। এটি শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং বর্তমানে উন্নত চিকিৎসার কারণে এর পাঁচ বছরের জীবনকাল প্রায় চারগুণ বেড়েছে। লিউকেমিয়ার ধরণগুলোর মধ্যে রয়েছে: অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া, অ্যাকিউট মায়েলয়েড লিউকেমিয়া, ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া এবং ক্রনিক মায়েলোজেনাস লিউকেমিয়া।
২. লিম্ফোমা: এটি লিম্ফাটিক সিস্টেমের ক্যান্সার, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশ। এতে লিম্ফোসাইট নামে বিশেষ শ্বেত রক্তকণিকা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায়। এই ক্যান্সারের ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে: হজকিন লিম্ফোমা, নন-হজকিন লিম্ফোমা, ফোলিকুলার লিম্ফোমা, এবং কিউটেনিয়াস টি-সেল লিম্ফোমা।
৩. মায়েলোমা: এই ক্যান্সার হাড়ের মজ্জায় উৎপন্ন প্লাজমা সেলগুলোতে শুরু হয় এবং অস্বাভাবিক প্লাজমা সেল তৈরি করে। বহুগুণিত মায়েলোমা হলো সবচেয়ে সাধারণ মায়েলোমার ধরন। এ ধরনের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে মানুষ পাঁচ বছরেরও বেশি বাঁচতে পারে।
ব্লাড ক্যান্সারের কারণ
ব্লাড ক্যান্সার তখনই ঘটে যখন শরীরের রক্তকণিকাগুলোর ডিএনএ তে কোন পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটে। এই পরিবর্তনের কারণ এখনও সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে কিছু গবেষণা বলছে যে পরিবেশগত ও জেনেটিক কিছু কারণ ব্লাড ক্যান্সারের জন্য দায়ী হতে পারে। যেমন:
- পরিবেশগত কারণ যেমন উচ্চ মাত্রার রেডিয়েশন বা নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থের সাথে দীর্ঘ সময়ের সংস্পর্শ এই ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে জিনগত পরিবর্তন এবং ক্রোমোজোমের অদল-বদলও লিউকেমিয়া তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
- এতে শ্বেত রক্তকণিকার লিম্ফোসাইটে জিনগত পরিবর্তন ঘটে, যা তাদের অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে এবং নিয়ন্ত্রণহীন হতে বাধ্য করে। কিছু সংক্রমণ এবং দুর্বল ইমিউন সিস্টেম লিম্ফোমা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- এই ক্ষেত্রে হাড়ের মজ্জার প্লাজমা সেলগুলিতে জিনগত পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে এগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ক্রোমোজোমের পরিবর্তনের সাথে মায়েলোমার যোগসূত্রের বিষয়ে গবেষণা চলছে।
- ক্যান্সারের সঠিক কারণ এখনো অজানা, তবে বেশ কিছু বিষয় এর ঝুঁকি বাড়ায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝুঁকি বাড়ে। ধূমপান, মদ্যপান, অস্বাস্থ্যকর খাবার, তেজস্ক্রিয়তা, কিছু রাসায়নিকের সংস্পর্শে থাকা, রোদে বেশিক্ষণ থাকা এবং বংশগত কারণও ক্যান্সারের জন্য দায়ী।
ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষণসমূহ
ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষণগুলো রোগী বিশেষে ভিন্ন হলেও কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে যা প্রায় সব ধরনের ব্লাড ক্যান্সারে দেখা যায়:
১. ক্লান্তি ও দুর্বলতা: অস্বাভাবিক ক্লান্তি, যা দৈনন্দিন কাজে প্রভাব ফেলে।
২. দীর্ঘস্থায়ী জ্বর: শরীরে সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্ষীণ হলে এই ধরনের জ্বর দেখা দিতে পারে।
৩. রাতের ঘাম: ঘুমানোর সময় অতিরিক্ত ঘাম, যা বিছানা ও পোশাক ভিজিয়ে দেয়।
৪. অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ ও সহজে ক্ষত: অল্প আঘাতেই রক্তক্ষরণ হওয়া বা ক্ষত চিহ্নের সময়ে না সারা।
৫. অবাঞ্ছিত ওজন হ্রাস: ছয় মাসে ১০ পাউন্ডের বেশি ওজন কমে যাওয়া।
৬. প্রায়শই সংক্রমণ: সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতার দুর্বলতার কারণে এটি হতে পারে।
৭. স্ফীত লিম্ফ নোড ও অঙ্গের বৃদ্ধি: লিম্ফোমা বা লিউকেমিয়ার ক্ষেত্রে এগুলো বেশি দেখা যায়।
৮. হাড়ের ব্যথা: মায়েলোমা বা লিউকেমিয়ার ক্ষেত্রে হাড়ে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
কিভাবে ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়
চিকিৎসকরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয় করেন। এর মধ্যে রয়েছে:
- কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (CBC): রক্তের শ্বেত কণিকার সংখ্যা এবং প্লেটলেটের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়।
- বোন ম্যারো বায়োপসি: হাড়ের মজ্জা থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়।
- সিটি স্ক্যান ও এমআরআই স্ক্যান: দেহের বিভিন্ন অঙ্গের অবস্থা নির্ণয় করতে ব্যবহৃত হয়।
ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি
ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা রোগীর অবস্থা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। চিকিৎসার প্রধান পদ্ধতিগুলো হলো:
- কেমোথেরাপি: ক্যান্সার সেল ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- রেডিয়েশন থেরাপি: ক্যান্সার আক্রান্ত স্থানে রেডিয়েশন প্রয়োগ করা হয়।
- ইমিউনোথেরাপি: শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট: ক্ষতিগ্রস্ত হাড়ের মজ্জা প্রতিস্থাপনের জন্য স্টেম সেল ব্যবহার করা হয়।
শেষ কথা
চিকিৎসা গবেষণা এবং চিকিৎসার বিকল্পগুলির অগ্রগতির কারণে, বর্তমানে কিছু ধরণের ব্লাড ক্যান্সারে বেঁচে থাকার হার বেশি এবং আরও অনুকূল ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। আশা করতেছি আমাদের এই আর্টিকেল থেকে ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষণ কি, কেন হয়, প্রকারভেদ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। যদি আর্টিকেল আপনাদের কাছে ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনার আশেপাশের ব্যক্তিদেরকে শেয়ার করে জানিয়ে দিবেন। ধন্যবাদ