শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে শুরু করলে বা উচ্চ তাপমাত্রাকে জ্বর বলা হয়। যে কোনো ইনফেকশনের সময় শরীর যখন আমাদের রক্ষার চেষ্টা করে, তখন জ্বর হয়। এতে সারা দিন শরীরের তাপমাত্রা ওঠানামা করে। সাধারণত সকালের দিকে কম থাকে, সন্ধ্যার পর বেড়ে যায়। জ্বর আসলে কোন রোগ নয়, বরং এটি রোগের একটি লক্ষণ বা উপসর্গ। ফলে জ্বর হওয়াকে শরীরের ভেতরের কোনো রোগের সতর্কবার্তা বলা যেতে পারে।
আমাদের দেহে যখন কোনো ভাইরাস এট্যাক করে কিংবা আমাদের দেহে যখন কোনো রোগ বাসা বাধে তখন আমাদের দেহ সেই রোগ কিংবা ভাইরাসকে প্রতিরোধ করা জন্য নিজের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর এটাকে আমরা জ্বর বলি। বারবার জ্বর আসা মানে আপনার দেহে কোনো রোগ বাসা বাধার চেষ্টা করছে কিংবা ভাইরাস দ্বরা আপনার দেহ বারবার এফেক্টেড হচ্ছে। এক্ষেত্রে যতো দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষুধ খেতে হবে।
কেন জ্বর হয়?
শরীরের তাপমাত্রা ৩৭.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৯.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট উঠলে তাকে জ্বর বলা হয়।। সাধারণত কি কি কারণে জ্বর হতে, পারে নিচে আলোচনা করা হলো।
- ম্যালিগনেন্সি বা ক্যান্সারের কারণে জ্বর হতে পারে।
- ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ।
- ভাইরাল সংক্রমণ যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা COVID-19।
- পাকস্থলী এবং অন্ত্রকে বা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল (GI) সংক্রমণ।
- কান, ফুসফুস, ত্বক, গলা, মূত্রাশয় বা কিডনির সংক্রমণ।
- ক্যান্সারযুক্ত (ম্যালিগন্যান্ট) টিউমার।
- জয়েন্টের আস্তরণের প্রদাহ।
- ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা টিকা।
- তাপজনিত অবসাদ বা তাপ ক্লান্তি।
- পিরিয়ডের কারণে।
- হরমোন ব্যাধি।
- অ্যামফিটামিন এবং কোকেনের মতো অবৈধ ওষুধ।
- আকস্মিক ভয় পেলে বা মানসিক আঘাত পেলেও জ্বর হতে পারে।
- বাচ্চাদের দাঁত উঠলে হালকা, নিম্ন-গ্রেডের জ্বর হতে পারে (101 ডিগ্রির বেশি নয়)।
জ্বর কমানোর ঘরোয়া উপায়
অনেক সময় হাসপাতালে না গিয়ে বাসায় থেকে ঘরোয়া উপায়ে জ্বর কমানো সম্ভব। আমরা জ্বর কমানোর কিছু প্রাকৃতিক ঘরোয়া পদ্ধতি এবং টিপস নিয়ে আলোচনা করবো।
গোসল ও গা মুছে দেওয়া
ভেজা গামছা বা তোয়ালে দিয়ে সারা শরীর মুছে দেওয়া। এ ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে হবে কুসুম গরম পানি। অনেকের ধারণা, জ্বর হলে গোসল করা যাবে না। এটি ভুল ধারণা। জ্বর হলে কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করলে তাপমাত্রা কমার পাশাপাশি শরীর চনমনে হয়। অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করা ঠিক হবে না।
পানিপট্টি দেওয়া
জ্বর কমানোর অন্যতম সেরা উপায় হলো মাথায় পানিপট্টি দেয়া। সেজন্য একটি পরিষ্কার রুমাল ভাঁজ করে সেটি পরিষ্কার পানিতে ভিজিয়ে নিন। cএরপর ভেজা রুমালটি রোগীর কপালের উপর দিয়ে রাখতে হবে। কিছুক্ষণ পর সেটি তুলে আবার পানিতে দিয়ে তা থেকে সামান্য পানি ফেলে দিয়ে আবার কপালের ওপর ধরুন। এভাবে কয়েকবার করলে শরীরের তাপমাত্রা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
বিশ্রাম নেওয়া
জ্বর প্রতিরোধ করতে আমাদের শরীরের প্রচুর শক্তি প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ঘুম বা বিশ্রাম এ সময় খুবই প্রয়োজন। কারণ ইমিউনিটি তখন সংক্রমণের সঙ্গে লড়াই করার জন্য নিরন্তর কাজ করে। এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্রাম নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
প্রচুর পরিমাণে পানি ও ডাবের পানি পান করুন
জ্বর হলে পানিশূন্যতার আশঙ্কা বেড়ে যায়। আমাদের শরীরের উচ্চ তাপমাত্রার ক্ষতিপূরণের জন্য আরও বেশি পানি প্রয়োজন হয়। পানিশূন্যতার কারণে মাংসপেশিতে চিবানো বা ব্যথা শুরু হতে পারে। রক্তচাপ ও প্রস্রাব কমে যেতে পারে। তাই সেই সময় প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। জ্বরের সময় দেহে ইলেকট্রোলাইটের যে অসমতা তৈরি হয়, তা পূরণে ডাবের পানির কোনো বিকল্প নেই।
তরল খাবার খাওয়া
প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খেতে হবে এ সময়। মিল্কশেক, জাউ ভাত ও পাতলা সুজি জ্বরের সময় বেশ উপকারী। এটি সহজপাচ্য ও সহজে খাওয়া যায়। বিভিন্ন সবজি ও মুরগি দিয়ে রান্না করা পাতলা খিচুড়ি খুব সহজেই ক্যালরি, প্রোটিন, ভিটামিন এবং মিনারেলের চাহিদা পূরণ করে দুর্বলতা দূর করে।
ফলের রস খাওয়া
ঘরে তৈরি ভিটামিন সি–যুক্ত তাজা ফলের রস যেমন কমলা, মাল্টা, জাম্বুরা, সবুজ আপেলের জুস ও আনারসের রস (চিনি ছাড়া) দ্রুত জ্বরের সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে। ভিটামিন-সি ইমিউনিটি সিস্টেমকে ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়তে সহায়তা করে। কমলা, আঙুর, মালটা, লেবু এগুলো খেতে হবে নিয়মিত।
আদা চা পান করুন
আদা চা জ্বর কমানোর জন্য একটি জনপ্রিয় ঘরোয়া প্রতিকার। আদা শরীর থেকে জীবাণু দূর করে শরীরকে টক্সিন মুক্ত করে। চায়ের সঙ্গে লেবু, মধু, তুলসীপাতা, পুদিনাপাতা ও লং মিশিয়ে খেলে ভাইরাসজনিত জ্বর কমানো সহজ হবে। দিনে ২-৩ বার পান করলে শরীরের অতিরিক্ত তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
আদা ও মধুর মিশ্রণ
আদা হলো প্রাকৃতিক অ্যান্টি ভাইরাস। আদার অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য জ্বরের সময় শরীরের প্রদাহ কমায়। । এককাপ গরম পানিতে আদা বাটা দিয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে নিন। এরপর তার সঙ্গে মেশান মধু। এই মিশ্রণ দিনে তিন-চারবার পান করতে হবে। ভালো ফল পেতে এ মিশ্রণের সঙ্গে লেবু মেশাতে পারেন।
খাবারে অরুচি দূরীকরণ
জ্বর হলে অনেক সময় বমিভাব দেখা দেয়, যার ফলে খাবারে অরুচি তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বমিভাব কমাতে ডমপেরিডন বা একই ধরনের ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। রোগীকে সুষম খাবার খাওয়াতে হবে, যা প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেলস, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, এবং প্রোটিনের যোগান দেবে। ছোট ছোট পরিমাণে বারবার খাবার দিন, যাতে রোগী সহজে হজম করতে পারে এবং অপুষ্টি থেকে রক্ষা পায়।
হালকা পোশাক পরা
জ্বর হলে গায়ে ভারী পোশাক বা কম্বল জড়িয়ে রাখা উচিত নয়। জ্বরের সময় সুতি কাপড়ের জামা পরা দরকার, যাতে ভেতর দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হয়। দরজা-জানালা খুলে দেবেন, পাখা ছেড়ে দেবেন, যাতে বাতাস চলাচল করে।
সতর্কতা
জ্বরের সময় ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলুন, শক্ত এবং কাঁচা খাবার এড়িয়ে চলা, বাইরের খাবার এড়িয়ে চলুন,অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার পরিহার করুন, দুধ চা এবং ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় বর্জন, কোমল পানীয় এবং সোডা পান থেকে বিরত থাকুন।
জ্বর কমানো নিয়ে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলি (FAQs)
১. জ্বর কতদিন স্থায়ী হতে পারে?
উত্তর: ভাইরাসজনিত জ্বর সাধারণত ৩-৫ দিনের মধ্যে কমে যায়। তবে জ্বরের তাপমাত্রা বেশি হলে বা দীর্ঘস্থায়ী হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
২. জ্বরের সময় বেশি পানি কেন খেতে হয়?
উত্তর: জ্বরের সময় শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে তরল বের হয়ে যায়, ফলে ডিহাইড্রেশন হতে পারে। পানি পান করলে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ হয়।
৩. কোন উপসর্গ থাকলে ডাক্তার দেখানো জরুরি?
উত্তর: যদি জ্বরের সাথে বুকের ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, তীব্র মাথাব্যথা বা শারীরিক দুর্বলতা থাকে, তাহলে অবিলম্বে ডাক্তার দেখানো উচিত।
৪. কীভাবে জানবো যে আমার জ্বর কমছে?
উত্তর: শরীরের তাপমাত্রা কমলে এবং অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা কমে গেলে বুঝতে পারবেন যে জ্বর কমছে। এছাড়া ঘাম হলে তা ভালো লক্ষণ।
৫.জ্বরে কোন ওষুধগুলো খুব ভালো কাজ করে?
উত্তর: মনে রাখবেন জ্বর হলে শুধু প্যারাসিটামাল খেয়ে বসে থাকলে হবে না। অনেক সময় অঙ্গের কর্মহীনতা ওর অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ এর আগাম সতর্কতার সিমটম হিসাবে জ্বর আসে। সেইক্ষেত্রে আপনি ডাক্তার দেখালে তিনি আপনাকে কিছু টেস্ট দিবেন যাথেকে আপনি আগাম কোন বড় বিপদ থেকে বেচে যাবেন।
এই পোস্ট শুধুমাত্র তাদের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ যারা বাসায় থেকে জ্বর কমানোর ঘরোয়া উপায় অনুসন্ধান করছিলেন। অতএব এই পোস্ট বেশি শেয়ার করে দিন (জ্বরের এন্টিবায়োটিক ট্যাবলেট এর নাম)। ধন্যবাদ