গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণ ও চিকিৎসা

বর্তমানে গ্যাস্ট্রিক চিনে না এমন কোনও ব্যক্তি নেই।আর এটি ডাক্তারি ভাষায় বলে পেপটিক আলসার ডিজিজ কিংবা গ্যাস্ট্রিক আলসার ডিজিজ বলা হয়। সকল মানুষেরই কমবেশি এই রোগ হয়। গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণ হল কোন কিছু খেলে পেট কামড়ানো ,বুক জ্বালা-পোড়া করা। এরকম সমস্যায় গ্যাস্ট্রিক আলসারের ঔষধ খেতে হবে।শুরুতে আপনি যদি সচেতন হন তবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই সমস্যাটি কতটা বেদনাদায়ক তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারে না।

এ জাতীয় রোগীরা তেল ভাজা, মশলাদার খাবার মোটেই খেতে পারেন না। এসব খাবার খেলেই পেটে অস্বস্তি ও জ্বালা শুরু হয়। এই ধরনের পরিস্থিতিতে ওষুধ সেবন অস্থায়ী স্বাচ্ছন্দ্য দেয় তবে পুরোপুরি রোগ নিরাময় করে না।

আলসারের লক্ষণগুলোকে গ্যাস্ট্রিক ভেবে ভুল করেন বেশিরভাগ মানুষই। এছাড়া আরো, ক্ষুধামন্দা, খিদে লাগবে না, বদহজম হবে, ওজন কমে যাবেতবে জানলে অবাক হবেন, এসব লক্ষণ কিন্তু আলসারেরও ইঙ্গিত দিতে পারে। তাই দীর্ঘদিন এসব সমস্যায় ভুগলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

আলসার শব্দের অর্থ দ্বারা ক্ষত বোঝানো হয়। পেটের ভেতেরে ক্ষতের সৃষ্টি হয় বলে একে স্টোমাক আলসার বা পেপটিক আলসার বলা হয়। মূলত পাকস্থলী বা ডিওডিনামে হয় পেপটিক আলসার।

আরও জানুন: পেটের গ্যাস কমানোর ঘরোয়া উপায়

আলসারের লক্ষণগুলো

আলসার যাদের রয়েছে বা হতে চলেছে তারা চোখ-কান খোলা রাখলে লক্ষণগুলো বুঝতে পারবেন। খেয়াল রাখুন-

১. পেটের ওপর ও মাঝামাঝি অংশে ব্যথা হবে। মনে হবে যেন পুড়ে যাচ্ছে। কেবলমাত্রা এন্টাসিড খেলেই এই ব্যথা থেকে মুক্তি মেলে।

২. খাওয়ার পর আলসারের ব্যথা নির্ভর করে ঠিক কোন স্থানে রোগ হয়েছে তার ওপর। গ্যাস্ট্রিক আলসার হলে খাওয়ার পর পরই পেটে ব্যথা বাড়তে পারে। আর ডুয়োডেনাল আলসার হলে পেটের ব্যথা বাড়ে খাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর।

৩. খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেটে ব্যথা শুরু হয়। এটা আলসারের লক্ষণ।

৪. ক্রমাগত ঢেঁকুর ওঠা এবং বমি ভাব আসা।

৫. অবসাদ ভাব ঘিরে ধরে। সাধারণত বমির আগে দিয়ে এমনটা মনে হয়।

গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণ

গ্যাস্ট্রিক আলসারের ব্যথা পেটের মাঝখান হতে ঘাড় পর্যন্ত উঠতে পারে। আবার নিচের দিকে নাভি পর্যন্ত যেতে পারে। পিঠেও এই ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ব্যথাটি সাধারণত খাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে শুরু হয়। অনেক সময় রাতে ঘুমের মধ্যে ব্যথা শুরু হয়ে ঘুম ভেঙে যেতে পারে। ডিওডেনাল আলসার, অর্থাৎ, পাকস্থলীর পর থেকে শুরু হওয়া অন্ত্রের প্রথম অংশে আলসার হলে ব্যথা সাধারণত খালি পেটে শুরু হয়। এন্টাসিডের মতো বদহজমের ঔষধ খেলে সাময়িকভাবে ব্যথা কমতে পারে। তবে আলসারের চিকিৎসা না করা পর্যন্ত ব্যথাটি বারবার ফিরে আসবে। গ্যাস্ট্রিক আলসারের আরও লক্ষণগুলো হলো-

১) খাওয়ার পরে পেট ফুলে থাকা বা পেট ফাঁপা হয়ে যাওয়া।

২) বুকে জ্বালাপোড়া করা।

৩) পেটের উপরের দিকে যন্ত্রণা হওয়া।

৪) মুখ দিয়ে নুন জল উঠা।

৫) বমি বমি ভাব হওয়া কিংবা বমি হয়ে যাওয়া।

৬) পিঠে ব্যথা অনুভব হওয়া।

৭) বেশি বেশি ঢেকুর উঠা।

৮) ক্ষুধা লাগে কিন্তু অল্প খাবারই ক্ষুধা মিটে যায়।

৯) খাওয়ার প্রতি আগ্রহ কম থাকে।

১০) মূত্রত্যাগের সময় রক্তপাত।

এই লক্ষণ গুলো দেখলে আপনি সহজেই আয়ত্ত করতে পারবেন যে আপনার গ্যাস্ট্রিকের আলসার আছে বা সম্ভাবনা আছে। তাই এ ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনি চিকিৎসকের কাছে গিয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন।

ডিওডেনাল আলসারের লক্ষণ

ডিওডেনাল আলসারের ক্ষেত্রে খুব ব্যথা হয়। যখ্ন তার ক্ষুধা লাগে, খুব ব্যথা হয়। আর ব্যথাটা এমন হতে পারে যে সে সরাসরি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে। ডিওডেনাল আলসার সাধারণত এভাবে হয়। যখনই তার ক্ষুধা লাগবে অনেক বেশি, তখনই তার ব্যথা বেশি হয়। এটা ছাড়াও অ্যান্টাসিড সিরাপ আছে, কিছু ট্যাবলেট আছে, রেনিটিডিন, ওমিপ্রাজল, এই ধরনের ওষুধগুলো খেলে লক্ষণগুলো কমে যায়। এভাবেও ডিওডেনাল আলসারকে নির্ণয় করা যায়।

পাকস্থলীর আলসারের লক্ষণ

পাকস্থলীর আলসারের সর্বাধিক পরিচিত লক্ষণগুলো এখানে তুলে ধরা হলো-

  • পাকস্থলীর আলসারের একটি প্রধান লক্ষণ হলো পেট ব্যথা করা।
  • অনেকের ক্ষেত্রে পাকস্থলীর আলসারে হজমে সমস্যা হয়ে থাকে।
  • অনেক সময় পাকস্থলীর আলসার হলে ক্ষুধামান্দ্য ভাব বা খাবারের অরুচি হয়।
  • বমি বমি ভাব ও বমি হওয়াও পাকস্থলীর আলসারের অন্যতম লক্ষণ।
  • পাশাপাশি এ সময় বুক জ্বালাপোড়া থাকতে পারে।
  • বমির সঙ্গে রক্ত যেতে পারে।
  • পায়খানার স্বাভাবিক রঙের পরিবর্তনও হতে পারে পাকস্থলীর আলসারের ক্ষেত্রে।

গলায় আলসারের লক্ষণ

গলায় আলসারের সর্বাধিক পরিচিত লক্ষণগুলো এখানে তুলে ধরা হলো-

  • মুখ ফুলে যাওয়া
  • গিলতে সমস্যা
  • গলাতে সাদা বা লাল প্যাচ
  • গলাতে ব্যথা
  • গলায় জ্বালা পোড়া

পেপটিক আলসারের লক্ষণ

পেপটিক আলসারের সর্বাধিক পরিচিত লক্ষণগুলো এখানে তুলে ধরা হলো-

  • পেটে জ্বালাপোড়া।
  • অম্বল।
  • বমি বমি ভাব।
  • চর্বিযুক্ত খাবারের অসহিষ্ণুতা।
  • ফুলে যাওয়া বা পেট ভরে থাকার অনুভূতি।
  • বমি।
  • রক্ত বমি হওয়া।
  • কালো, বা টারি মল।
  • মলে রক্ত।
  • মাথা ঘুরছে।
  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
  • ব্যাখ্যাতীত ওজন হ্রাস।
  • ক্ষুধা পরিবর্তন।

গ্যাস্ট্রিক আলসারের চিকিৎসা

লসার বা পেটের আলসারের চিকিৎসা কেমন হবে তা মূলত নির্ভর করে ঠিক কোন কারণে আলসারটি হয়েছে সেটির ওপর। সঠিক চিকিৎসা পেলে অধিকাংশ পেটের আলসারই সাধারণত এক থেকে দুই মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ সেরে ওঠে।

১. বেশিরভাগ আলসার চিকিৎসায় প্রথমে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর (পিপিআই) গ্রুপের ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। এগুলোকে আমরা সাধারণত গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ হিসেবে চিনি। যেমন: ওমিপ্রাজল, প্যান্টোপ্রাজল, ইসোমিপ্রাজল, ল্যানসোপ্রাজল, ডেক্স-ল্যানসোপ্রাজল, র‌্যাবিপ্রাজল অ্যান্টাসিড, সুক্রালফেট আলসার নির্মূলকরণ ঔষধ। পিপিআই পাকস্থলী হতে গ্যাস্ট্রিক এসিডের নিঃসরণ কমিয়ে দেয়, ফলে আলসার বা ক্ষতস্থানটি নিজে নিজে সেরে ওঠে।

২. নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস বা NSAIDs গ্রুপের ঔষধ (যেমন: ন্যাপ্রক্সেন, অ্যাসপিরিন, এসিক্লোফেনাক ও ডাইক্লোফেনাক) সেবনের ফলে আলসার হলে পিপিআই সেবন করতে হয়।

৩. আপনি NSAIDs-জাতীয় ঔষধ সেবন চালিয়ে যাবেন কি না সেই বিষয়েও ডাক্তার আপনার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিবেন। প্রয়োজনে এসব ঔষধের পরিবর্তে প্যারাসিটামলের মতো বিকল্প প্রদাহনাশক বা ব্যথানাশক ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।

৪. হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি (H. pylori) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ইনফেকশনের কারণে আলসার হয়ে থাকলে পিপিআই এর পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়।

৫. কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তার পিপিআই জাতীয় ঔষধের বিকল্প হিসেবে ‘এইচ টু (H2) রিসেপ্টর ব্লকার’ গ্রুপের ঔষধ (যেমন: H 2 A 150Mg Tablet, ফ্যামোটিডিন) সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন। কখনো কখনো এন্টাসিড জাতীয় ঔষধও দেওয়া হয়। এন্টাসিড বুক জ্বালাপোড়া ও গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা দ্রুত উপশম করে৷

৬. নিয়মিত ঔষধ সেবনের ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পরে আবার এন্ডোস্কোপি করে আলসারের স্থানটি পর্যবেক্ষণ করা হয়।

৭. আলসারের ঔষধ খাওয়ার সময় কোনো বিশেষ নিয়ম মেনে চলার প্রয়োজন হয় না। তবে মশলাদার খাবার, ধূমপান, মদ্যপান ও দুশ্চিন্তা এড়িয়ে চললে তা আলসার সারাতে সহায়ক হতে পারে।

৮. চিকিৎসা নিয়ে সেরে ওঠার পরেও পাকস্থলীতে আবার আলসার হতে পারে। তবে যে কারণে আলসার হয়েছিল তা নির্মূল করা সম্ভব হলে পরবর্তীতে আবার আলসারের সমস্যা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

আলসার জন্য ঘরোয়া প্রতিকার

কর্মব্যস্ত জীবনে কাজের চাপে আমরা খেতেও ভুলে যাই। দীর্ঘ ক্ষণ খালি পেটে থাকলেও আলসারের ঝুঁকি বাড়ে। কিছু ঘরোয়া প্রতিকার এবং জীবনধারার পরিবর্তনগুলি পেটের আলসারের লক্ষণগুলি উপশম করতেও সাহায্য করে।

১. কিছু খাবার আছে আলসার সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া হেলিকোব্যাকটার পাইলোরির বিরুদ্ধে লড়াই করে। যেমন: ফুলকপি , বাধাকপি, মুলা, আপেল, ব্লুবেরি, র‌্যাস্পবেরি, স্ট্রবেরি, ক্যাপসিকাম, ব্রোকোলি, গাজর, দই, মধু, অলিভ অয়েল এবং অন্যান্য উদ্ভিদভিত্তিক তেল, রসুন, ক্যাফেইনমুক্ত গ্রিন টি, যষ্টিমধু , আদা গ্রহণ করলে গ্যাস্ট্রিক আলসারের উপশমে সহায়ক হতে পারে।

২. ঠান্ডা দুধ, টক দই, ডিম (সিদ্ধ), ভাত, রুটি, সিদ্ধ আলু, কুমড়া, লাউ, শসা, পেঁপে – এই ধরণের হালকা খাবার খান। খাবার ভালো করে চিবিয়ে খাবেন। অল্প অল্প করে বারবার খাবেন। ঝাল-মশলা, টক ফল (লেবু, কমলা), আচার, গরুর মাংস, ভাজা-পোড়া, চকলেট, কফি, কোল্ড ড্রিঙ্কস – এগুলো আপনার আলসার আরও খারাপ করতে পারে।

৩. টেনশন, চিন্তা, উদ্বেগ – এগুলো আলসারের জন্য ভালো নয়। ধ্যান করুন, গান শুনুন, বই পড়ুন, প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটান, যা কিছু আপনাকে আনন্দ দেয় তা করুন। রাতে ভালো মতো ঘুমান। দিনের বেলা কিছুক্ষণ আরাম করুন। আলসার সম্পূর্ণ ভাবে না সারা পর্যন্ত ভারী কাজ বা কঠোর ব্যায়াম এড়িয়ে চলুন।

৪. গ্যাস্ট্রিক আলসারের চিকিৎসা য় পুদিনা পাতা অত্যন্ত কার্যকর। এক কাপ পানিতে পাঁচ -ছয়টা পুদিনা পাতা সিদ্ধ করে সেই পানি খেলে পেট ফাঁপা এবং বমিভাব দূর হয়।

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে?

আপনার যদি পাকস্থলীর আলসারের কোনো লক্ষণ আছে বলে মনে হয় তবে ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন। এছাড়া নিচের যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। বিশেষ করে, যদি আপনার বমির সাথে লাল রক্ত বা কফির দানার মতো কিছু দেখতে পান, পায়খানা কালো এবং আঠালো হয়, অথবা পেটে হঠাৎ করে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। এই লক্ষণগুলো ঝুঁকিপূর্ণ এবং আপনার শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিনা তা বোঝাতে পারে। সুতরাং, এক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শেষ কথা

আজকে আমাদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণগুলো এবং চিকিৎসা কিভাবে করবেন। এই রোগটিই একটা সময়ে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। হতে পারে বিভিন্ন ধরনের সমস্যাও। গ্যাস্ট্রিক আলসার থেকে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। তাই আগে থেকেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আশা করতেছি আমাদের এই আর্টিকেল থেকে গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণগুলো এবং চিকিৎসা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। যদি আর্টিকেল আপনাদের কাছে ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনার আশেপাশের ব্যক্তিদেরকে শেয়ার করে জানিয়ে দিবেন। ধন্যবাদ

 

 

 

1 thought on “গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণ ও চিকিৎসা”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top