টাইফয়েড জ্বরের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

টাইফয়েড জ্বর বাংলাদেশে খুবই সচরাচর একটি রোগ। টাইফয়েড জ্বর একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যা স্যালমোনেলা টাইফি (Salmonella Typhi) নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। এটি প্রধানত দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে জীবাণুগুলো গুণিতক আকারে বেড়ে গিয়ে রক্তস্রোতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে জ্বর এবং ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।

টাইফয়েডের ব্যাকটেরিয়া সাধারণত মানুষের বাহক দ্বারা খাদ্য বা পানিতে জমা হয় এবং তারপর এলাকার আশেপাশের অন্যান্য লোকেদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। টাইফয়েড জ্বর অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে এবং চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যেখানে বিশুদ্ধ পানির অভাব ও সঠিক স্যানিটেশনের ঘাটতি রয়েছে, সেখানে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।

টাইফয়েড জ্বরের কারণ ও ছড়ানোর মাধ্যম

টাইফয়েড একটি পানিবাহিত মারাত্মক রোগ যা সালমোনেলা টাইফি ও সালমোনেলা প্যারাটাইফি দুই ধরনের জীবাণুর সংক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে। সালমোনেলা টাইফির সংক্রমণে যে জ্বর হয় তাকে টাইফয়েড জ্বর বলে। আর যদি জ্বর সালমোনেলা প্যারাটাইফির নামক জীবাণুর কারণে হয় তখন তাকে প্যারা টাইফয়েড জ্বর বলে। প্রধানত টাইফয়েড জ্বর ছড়ায় দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে। যখন কেউ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়, তার মল এবং প্রস্রাবে এই ব্যাকটেরিয়া থাকে। যদি সঠিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকে এবং সেই মল বা প্রস্রাব পানির সাথে মিশে যায়, তখন সেই পানি থেকে খাদ্য বা পানীয় দূষিত হতে পারে। এছাড়াও, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা, বিশেষত যদি আক্রান্ত ব্যক্তি হাত পরিষ্কার না করে খাবার স্পর্শ করে, তখনও রোগটি অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই এই রোগটি ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম হলো:

  • দূষিত পানি।
  • দূষিত খাদ্য।
  • হাত ধোয়ার অভাব।

টাইফয়েড জ্বরের বিভিন্ন উপসর্গ

টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে দেখা দিতে পারে, যা প্রায়ই প্রথমে অন্যান্য সাধারণ রোগের মতো মনে হয়। সাধারণত লক্ষণগুলো সংক্রমণের ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে দেখা দেয়। অনেক সময় টাইফয়েডের লক্ষণগুলো অন্যান্য সাধারণ ফ্লু বা ভাইরাল জ্বরের মতো হতে পারে। টাইফয়েডের প্রধান লক্ষণগুলো হলো:

  • উচ্চ জ্বর, যা ১০৩-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে।
  • শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া ও বমি হতে পারে।
  • হৃদস্পন্দন কমে যেতে পারে।
  • মাথাব্যথা।
  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি।
  • প্রচণ্ড পেটে ব্যথা।
  • ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য।
  • ক্ষুধামন্দা ও ওজন হ্রাস।
  • শরীরে লালচে ছোট দাগ (র‍্যাশ)।
  • বমি বা বমি বমি ভাব।

কিভাবে টাইফয়েড জ্বর সনাক্তকরণ করা হয়

পরীক্ষা নিরীক্ষার পরই শুধু টাইফয়েড শনাক্ত করা যায়। এজন্য ‘ব্লাড কালচার‘ নামক রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। রক্তের নমুনায় স্যালমোনেলা নামক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেলে টাইফয়েড হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। এছাড়া জ্বর হওয়ার ২য় সপ্তাহে ‘উইডাল টেস্ট‘ নামে একটি ননস্পেসিফিক ব্লাড টেস্ট করার মাধ্যমে টাইটার দেখে স্যালমোনেলা টাইফির বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি চিহ্নিত করা যায়।

টাইফয়েড জ্বরের কারণে

টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, যা সংক্রমণের ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে। তবে, রোগীর অবস্থা ও জটিলতার উপর ভিত্তি করে অ্যান্টিবায়োটিকের ধরন ও মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীকে অধিক পরিমাণে তরল খাবার দেওয়া দরকার কারণ দীর্ঘস্থায়ী জ্বর এবং ডায়রিয়ার কারণে তাঁর শরীরে পানি স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। টাইফয়েডের রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। অসুস্থতাকালীন সময়ে হারানো পুষ্টি পুনরুদ্ধারে উচ্চ ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত। চিকিৎসা না করালে টাইফয়েড জ্বর থেকে গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, যেমন অন্ত্র ফেটে যাওয়া বা রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাওয়া।

টাইফয়েড জ্বরের ভ্যাকসিন কি

একটি টাইফয়েড টিকা রোগের সূত্রপাত প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। আন্তর্জাতিকভাবে দুটি ভ্যাকসিন পাওয়া যায়। একটি লাইভ, অ্যাটেনুয়েটেড ভ্যাকসিন যা মৌখিকভাবে নেওয়া হয়, অন্যটি একটি নিষ্ক্রিয় ভ্যাকসিন যা শট হিসাবে দেওয়া হয়। উভয় টিকাই শরীরকে উদ্দীপিত করে, অ্যান্টিবডি তৈরি করতে যা টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে। বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্ক যারা প্রায়শই ভ্রমণ করেন, বিশেষ করে এমন এলাকায় যেখানে স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি খারাপ, তাদের অবশ্যই অসুস্থতার বিরুদ্ধে টিকা দিতে হবে, কারণ এই এলাকায় টাইফয়েড জ্বর উদ্বেগের বিষয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ স্থানগুলির মধ্যে কয়েকটি হল এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ এবং মধ্য আমেরিকা।

টাইফয়েড জ্বরের প্রতিরোধে করণীয়

সব সময় ভ্যাকসিন ১০০% কার্যকর হয়না। টাইফয়েড জ্বর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
১.নিজে খাওয়ার পূর্বে বা শিশুকে খাওয়ানোর পূর্বে সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত পরিষ্কার করতে হবে ও শৌচাগার ব্যবহারের পর সবসময় সাবান দিয়ে হাত ধোয়া।
২. খাওয়া ও রান্নায় বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার করা।
৩. ভালোভাবে রান্না করা খাবার খাওয়া।
৪. রাস্তার পার্শ্বস্থ দোকানের খাবার এড়িয়ে চলা।
৫. টয়লেট সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে।

টাইফয়েড জ্বর সংক্রমণ নিয়ে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলি (FAQs)

১. টাইফয়েড কি সহজে ছড়ায়?
হ্যাঁ, টাইফয়েড প্রধানত দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকলে এর সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে।

২. টাইফয়েড থেকে সুস্থ হতে কতদিন সময় লাগে?
টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসা প্রায় ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তবে পূর্ণ সুস্থ হতে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

৩. টাইফয়েড কি একবার হলে আর হয় না?
একবার টাইফয়েড হলে শরীরে কিছু ইমিউনিটি তৈরি হয়, তবে পরবর্তীতে আবারও টাইফয়েড হতে পারে, তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও ভ্যাকসিন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

৪. কি ধরনের খাবার খাওয়া উচিত টাইফয়েড জ্বরের সময়?
হালকা, সুষম ও তরল জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। প্রচুর পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ খাবারও পরামর্শযোগ্য।

৫. টাইফয়েড থেকে সেরে ওঠার পর শরীর দুর্বল লাগে। এখন করণীয় কী হতে পারে?
আপনি appetite বাড়ায় এমন কিছু খান, Lysivin Tablet ১ টা করে ২ বার খাবেন 1 month. প্রোটিন ঘাটতি মেটাতে ডিম, মাছ, মুরগি, ডাল সাথে সবজি, ভাত, রুটি যা যা পছন্দ খেতে থাকুন।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top