লিভার নষ্টের লক্ষণ কি???

লিভার বা যকৃত আমাদের শরীরের এক অবিচল ও অপরিহার্য কর্মী, যা নিরবচ্ছিন্নভাবে রক্ত পরিশোধন থেকে শুরু করে হজমে সহায়তা পর্যন্ত অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। লিভারের স্বাস্থ্য যখন ভালো থাকে, তখন শরীর থাকে ফিট আর মন প্রফুল্ল; কিন্তু যদি লিভার দুর্বল বা অসুস্থ হয়ে যায়, তার প্রভাব পড়ে পুরো শরীরে। আজকাল ব্যস্ত জীবনের চাপ, অনিয়ন্ত্রিত খাবার এবং অ্যালকোহল সেবন অনেকের লিভারের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তাই লিভারের যত্ন নেওয়া এবং এর বিভিন্ন কাজ, রোগের লক্ষণ, এবং প্রতিরোধের উপায় জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পোস্টে আমরা লিভারের প্রধান কার্যক্রম, অসুস্থতার প্রাথমিক লক্ষণ, ক্যান্সারের সম্ভাব্য উপসর্গ এবং লিভার সুস্থ রাখতে করণীয় সম্পর্কে জানবো।

লিভার আমাদের শরীরে কি কি কাজ করে?

লিভার আমাদের শরীরে এক গুরুত্বপূর্ণ কর্মী, যা নিরন্তর অসংখ্য কাজ করে। এটি রক্তকে পরিশোধন করে, শরীরের বিষাক্ত পদার্থ যেমন অ্যামোনিয়া, ঔষধের উপজাত, ও অ্যালকোহল শোধন করে ফেলে। পুরোনো লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে এবং রক্ত জমাট বাঁধাতে সাহায্য করে লিভার। এটি গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেন আকারে জমা করে রাখে এবং শক্তির প্রয়োজন হলে তা সরবরাহ করে। লিভার “বাইল” নামক এক ধরনের রস তৈরি করে, যা চর্বি হজমে সাহায্য করে। খাদ্য থেকে পাওয়া পুষ্টি প্রক্রিয়াজাত করে শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে দেয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও খনিজ জমা করে। এটি অন্ত্র থেকে আসা রক্ত শোধন করে খাবার, অ্যালকোহল, ও ঔষধের বিষাক্ত উপাদানগুলো প্রস্রাব বা পায়খানার মাধ্যমে শরীর থেকে বের করতে সহায়তা করে। শরীরের রোগপ্রতিরোধে ও মস্তিষ্কের কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, আমাদের সুস্থতার জন্য লিভার অপরিহার্য।

লিভার নষ্টের প্রাথমিক লক্ষণ

  • মুখের দুর্গন্ধ: লিভারের সমস্যায় মুখ থেকে বাজে (পেঁয়াজ বা মাছের মত) গন্ধ হতে পারে।
  • হজমের সমস্যা: লিভারের ক্ষতির কারণে জল হজমেও সমস্যা হতে পারে।
  • ডার্ক সার্কেল এবং ক্লান্ত চোখ: চোখের নিচের ত্বক কোমল হলে লিভারের সমস্যা থাকতে পারে।
  • ত্বকের দাগ এবং বিবর্ণতা: লিভারের সমস্যায় ত্বক বিবর্ণ এবং সাদা দাগযুক্ত হতে পারে।
  • গাঢ় প্রস্রাব এবং মল: লিভারের সমস্যায় প্রস্রাব এবং মলের রং গাঢ় হতে পারে।
  • হলুদ চোখ: হলুদ চোখ জন্ডিসের লক্ষণ, যা লিভারের রোগের সাথে সম্পর্কিত।
  • পেট ফুলে যাওয়া: লিভারের সংক্রমণ বা ক্ষতির কারণে পেট ফুলে যেতে পারে।
  • মুখে তিক্ত স্বাদ: লিভারের সমস্যায় মুখে তিক্ত ধাতব স্বাদ হতে পারে।

লিভারের বেশি ক্ষতির ফলে কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে

  • ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া এবং চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া।
  • অনেক সময় পায়ে পানি জমে, যার ফলে পা ফুলে যায়।
  • পেটে পানি জমে পেট ফুলে যেতে পারে।
  • হঠাৎ করে জ্বর আসা এবং শরীর কাঁপতে শুরু করা।
  • প্রচন্ড চুলকানি, যা সহ্য করা অনেক কষ্টকর।
  • মাথার চুল ঝরে ঝরে পড়তে থাকে।
  • আঙ্গুলের ডগা এবং নখ বাঁকা হয়ে যাওয়া।
  • তালু লাল হয়ে যাওয়া।
  • খাওয়া-দাওয়া ঠিক থাকলেও ওজন কমতে থাকে।
  • শরীরে শক্তি থাকে না, পেশীগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • মাথা ঘোরা, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা এবং ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন।
  • বমি করার সময় রক্ত বেরিয়ে আসা।
  • নাক, মাড়ি থেকে সহজেই রক্তপাত হওয়া।
  • লিভার ঠিকমতো কাজ না করায়, মদ এবং ওষুধ শরীরের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে।

মনে রাখবেন, লিভারের সমস্যাগুলোকে অবহেলা করা ঠিক নয়। সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত একজন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।

লিভার ক্যান্সারের কিছু লক্ষণ

লিভার ক্যান্সার ধরা পড়া বেশ কঠিন কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে এর লক্ষণগুলো স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না। তবে কিছু লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।

  • পেটে ব্যথা: বিশেষ করে উপরের ডান দিকে ব্যথা হতে পারে।
  • ওজন কমে যাওয়া: কারণ ছাড়াই ওজন কমতে থাকলে সতর্ক হতে হবে।
  • ক্ষুধামান্দ্য: খাওয়ার ইচ্ছা কমে যাওয়া।
  • বমি বমি ভাব বা বমি: বারবার বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া।
  • পেট ফুলে যাওয়া: পেটে পানি জমে ফুলে যেতে পারে।
  • জন্ডিস: ত্বক এবং চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া।
  • অবসাদ: সব সময় ক্লান্তি অনুভব করা।
  • জ্বর: বারবার জ্বর আসা।

লিভার ক্যান্সারের লক্ষণ আরও স্পষ্ট হতে পারে

মনে রাখবেন, এই লক্ষণগুলো অন্যান্য রোগের কারণেও হতে পারে। তাই এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে লিভার ক্যান্সার নির্ণয় করতে পারবেন।

  • লিভার বড় হয়ে যাওয়া।
  • লিভার ক্যান্সারের কারণে প্লীহাও বড় হতে পারে।
  • খাদ্যনালীতে রক্তক্ষরণ হলে রক্ত বমি হতে পারে।
  • পায়খানার সাথে রক্ত বের হলে পায়খানা কালো দেখায়।
  • হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই হেপাটাইটিস হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
  • দীর্ঘদিন ধরে লিভারের ক্ষতি হতে থাকলে লিভার সিরোসিস হয়। লিভার সিরোসিস লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

প্রাথমিক পর্যায়ে লিভার ক্যান্সার ধরা পড়লে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

লিভারটি সুস্থ রাখতে করণীয়

লিভারটি সুস্থ রাখতে নিম্নলিখিত করণীয় অনুসরণ করা উচিত:

১. শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করা লিভারের সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে। প্রায়শই ভুনা, স্টিম করা বা গ্রিল করা মাংস, মাছ, সাদা মাংস, সবুজ সবজি, ফল এবং পুষ্টিকর অনান্ন গ্রহণ করুন। প্রয়োজনে ডায়েটিশিয়ানের সাথে আলাপ করুন যাতে আপনি শুধুমাত্র লিভারের সুস্থতা বজায় রাখতে উপযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে পারেন।
২. পর্যাপ্ত পানি পান করা লিভারের সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৮- ১০ গ্লাস পানি পান করুন।
৩. লিভারের সুস্থতা বজায় রাখতে নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। মাংসের পরিবর্তে বাদাম, দই, পনির, টোফু, লেন্টিল, ডাল ইত্যাদি খাদ্যগুলি ভাল বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
৪. অতিরিক্ত অ্যালকোহল খাবার লিভারের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আপনি সামান্য পরিমাণে অ্যালকোহল গ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু বিরত হওয়া উচিত।
৫. নিয়মিত ব্যায়াম করা লিভারের সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। মানসিক এবং শারীরিক ব্যায়াম প্রয়োগ করুন যেন সুস্থ থাকেন।
৬. যদি আপনার কোনও ঔষধ বা বিশেষ খাবার লিভারের জন্য ক্ষতিকর হয়, তবে বৈদ্যমানের নির্দেশানুযায়ী আপনার ঔষধ পরিবর্তন করুন বা খাবার পরিবর্তন করুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top