স্ক্যাবিস রোগের ঔষধের নাম, কীভাবে কাজ করে ও দাম কত?

স্ক্যাবিস একটি সংক্রামক চর্মরোগ যা একটি ক্ষুদ্র পরজীবী মাইট (Sarcoptes scabiei) দ্বারা সৃষ্ট। এই রোগটি অত্যন্ত চুলকানি এবং অস্বস্তিকর হতে পারে। স্ক্যাবিসের চিকিৎসা সঠিকভাবে না হলে এটি অন্যদের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই এই রোগটি নিরাময়ে সঠিক ঔষধ নির্বাচন, প্রয়োগ পদ্ধতি এবং এর দাম জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নিবন্ধে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে স্ক্যাবিস রোগের ঔষধের নাম, কীভাবে তারা কাজ করে এবং তাদের দাম।

স্ক্যাবিস কীভাবে সৃষ্টি হয়?

স্ক্যাবিস হলো একটি সংক্রামক চর্মরোগ যা Sarcoptes scabiei নামক ক্ষুদ্র মাইটের আক্রমণে হয়। এই মাইটগুলো মানুষের ত্বকের উপর গর্ত তৈরি করে এবং সেখানে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে লার্ভা সৃষ্টি হয়, যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়। মাইটগুলি সাধারণত ত্বকের পাতলা অংশে বেশি বাস করে, যেমন আঙুলের ফাঁক, কনুই, কোমর, এবং ঘাড়ের চারপাশে। এই সংক্রমণ অল্প সময়ের মধ্যে তীব্র চুলকানি এবং ত্বকের প্রদাহ তৈরি করতে পারে।

স্ক্যাবিস কীভাবে ছড়ায়?

স্ক্যাবিস অত্যন্ত সংক্রামক এবং এটি একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে খুব সহজেই ছড়ায়। সংক্রমণের প্রধান মাধ্যমগুলো হলো:

  • শারীরিক সংস্পর্শ: দীর্ঘ সময় ধরে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে এলে মাইট ছড়িয়ে পড়ে।
  • ব্যক্তিগত সামগ্রী ব্যবহার: আক্রান্ত ব্যক্তির পোশাক, তোয়ালে, বিছানার চাদর বা কোলবালিশ ব্যবহার করলেও সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
  • জনাকীর্ণ পরিবেশ: স্কুল, শিবির বা যেকোনো জনাকীর্ণ স্থানে থাকা ব্যক্তি সহজেই আক্রান্ত হতে পারে।

বিশেষ সতর্কতা: স্ক্যাবিস আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বক দেখলে প্রাথমিকভাবে ছোট লাল ফুসকুড়ি এবং সর্পিলাকার রেখা দেখা যায়। এ রোগের চুলকানি রাতের বেলায় বেশি হয়, যা রোগীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করে।

স্ক্যাবিস কেন হয়?

স্ক্যাবিস মূলত Sarcoptes scabiei নামক ক্ষুদ্র পরজীবী মাইটের আক্রমণে হয়। মাইটটি ত্বকের নিচে গর্ত করে ডিম পাড়ে, যা থেকে লার্ভা তৈরি হয় এবং সংক্রমণ ছড়ায়।

প্রধান কারণ:

  • আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে শারীরিক সংস্পর্শ।
  • অপরিষ্কার পরিবেশে বসবাস।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির পোশাক, তোয়ালে বা চাদর শেয়ার।
  • জনাকীর্ণ স্থানে দীর্ঘ সময় থাকা।

লক্ষণ: তীব্র চুলকানি, লাল ফুসকুড়ি, এবং ত্বকে সর্পিলাকার গর্ত। দ্রুত চিকিৎসা সংক্রমণ রোধে সাহায্য করে।

স্ক্যাবিস রোগের ঔষধের নাম ও তাদের কার্যপ্রক্রিয়া

স্ক্যাবিস চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন কার্যকর ঔষধ পাওয়া যায়, যা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকর। এগুলো সাধারণত টপিকাল ক্রিম, লোশন, বা মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট আকারে ব্যবহৃত হয়। নিচে স্ক্যাবিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর ঔষধের নাম এবং তাদের কার্যপ্রক্রিয়া বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

১. স্ক্যাবিসের চিকিৎসায় পারমেথ্রিন ৫% ক্রিম অন্যতম জনপ্রিয় একটি ঔষধ। এটি সরাসরি ত্বকের উপর প্রয়োগ করে মাইট এবং তাদের ডিম ধ্বংস করতে সাহায্য করে। স্ক্যাবিস আক্রান্ত ত্বক পরিষ্কার ও শুকিয়ে নেওয়ার পর এই ক্রিম ব্যবহার করতে হয়। এটি ত্বকে ৮-১৪ ঘণ্টা রেখে পরে ধুয়ে ফেলতে হয়। বাজারে এর দাম ১০০-১৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়, এবং এটি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক সবার জন্য নিরাপদ।

২. ইভারমেক্টিন ট্যাবলেট মুখে খাওয়ার জন্য একটি শক্তিশালী ঔষধ, যা জটিল স্ক্যাবিস চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি মাইটের নার্ভ সিস্টেমে আক্রমণ করে তাদের প্যারালাইজ করে ধ্বংস করে। সাধারণত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এটি ১-২ ডোজ নেওয়া হয়। এই ঔষধের দাম ৩০০-৫০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। এটি গুরুতর সংক্রমণের ক্ষেত্রে কার্যকর এবং টপিকাল ঔষধের বিকল্প হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

৩. সালফার মলম (১০%) একটি পুরনো এবং প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি স্ক্যাবিসের ঔষধ। এটি মাইট ধ্বংসের পাশাপাশি ত্বকের প্রদাহ এবং চুলকানি কমাতে সাহায্য করে। এটি দিনে ২-৩ বার আক্রান্ত স্থানে ব্যবহার করতে হয়। এর দাম তুলনামূলক কম, যা ৫০-১০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। গর্ভবতী নারী এবং শিশুর জন্য এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ।

৪. লিনডেন লোশন (১%) স্ক্যাবিসের মাইট এবং তাদের ডিম ধ্বংসে কার্যকর একটি লোশন। এটি ত্বকের আক্রান্ত স্থানে প্রয়োগ করে ৮ ঘণ্টা রেখে পরে ধুয়ে ফেলতে হয়। তবে এই ঔষধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি, কারণ এটি শিশুদের জন্য নিরাপদ নয়। বাজারে এর দাম ২০০-৩০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।

৫. অন্যদিকে, সেট্রিমাইড লোশন স্ক্যাবিসের প্রাথমিক অবস্থায় ত্বক পরিষ্কার রাখতে এবং সংক্রমণ রোধে ব্যবহৃত হয়। এটি গোসলের সময় ব্যবহার করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। এর দাম ৭০-১২০ টাকার মধ্যে। এই লোশন ত্বক পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি মাইট ধ্বংসে কার্যকর।

ঔষধের তুলনামূলক টেবিল:

ঔষধের নাম কাজের ধরন ব্যবহার পদ্ধতি দাম (টাকা)
পারমেথ্রিন ৫% ক্রিম মাইট এবং ডিম ধ্বংস শরীরে মাখিয়ে ৮-১৪ ঘণ্টা পর ধুয়ে ফেলুন ১০০-১৫০
ইভারমেক্টিন ট্যাবলেট মাইট প্যারালাইজ করে ধ্বংস মুখে খাওয়া (ডোজ অনুযায়ী) ৩০০-৫০০
সালফার মলম (১০%) প্রদাহ কমায় এবং মাইট ধ্বংস দিনে ২-৩ বার প্রয়োগ করুন ৫০-১০০
লিনডেন লোশন (১%) মাইট ও ডিম ধ্বংস ৮ ঘণ্টা রেখে ধুয়ে ফেলুন ২০০-৩০০
সেট্রিমাইড লোশন ত্বক পরিষ্কার এবং সংক্রমণ রোধ প্রতিদিন ব্যবহার করুন ৭০-১২০

স্ক্যাবিসের সাবান

স্ক্যাবিস চিকিৎসায় সাধারণ সাবান ব্যবহার যথেষ্ট নয়। বিশেষ সাবানগুলো মাইট ধ্বংসে কার্যকর:

  • পারমেথ্রিন সাবান: ১%-৫% পারমেথ্রিনে স্ক্যাবিস মাইট ধ্বংস করে। গোসলের সময় পুরো শরীরে ব্যবহার করুন।
  • সালফার সাবান: প্রাকৃতিক সালফার ত্বকের মাইট ধ্বংস করে এবং প্রদাহ কমায়। দিনে ১-২ বার ব্যবহার করুন।
  • নিম সাবান: অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণে প্রাথমিক স্ক্যাবিসে কার্যকর।

ব্যবহার: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সাবান ব্যবহার করুন এবং পরিষ্কার পোশাক ব্যবহার নিশ্চিত করুন।

স্ক্যাবিস চিকিৎসার সঠিক পদ্ধতি

স্ক্যাবিস সম্পূর্ণ নিরাময়ের জন্য সঠিক পদ্ধতিতে ঔষধ ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি ধাপ মেনে চলুন:

  1. ঔষধ প্রয়োগের পূর্বে গোসল করুন:
    স্ক্যাবিস মাইট ধ্বংস করতে ঔষধের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য ত্বক পরিষ্কার রাখা জরুরি।
  2. সঠিক প্রয়োগ পদ্ধতি অনুসরণ করুন:
    স্ক্যাবিসের জন্য ব্যবহৃত ঔষধ পুরো শরীরে প্রয়োগ করতে হয়। এমনকি এমন স্থানেও যেখানে স্ক্যাবিসের লক্ষণ নেই।
  3. নখ ছোট করে রাখুন:
    স্ক্যাবিসে চুলকানি কমানোর জন্য নখ ছোট রাখা প্রয়োজন, কারণ খোঁচানোর ফলে সংক্রমণ বাড়তে পারে।
  4. সাথে থাকা সবাইকে চিকিৎসা দিন:
    পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও প্রায়ই সংক্রমিত হন। তাই একসঙ্গে চিকিৎসা গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।

স্ক্যাবিস দূর করার ঘরোয়া উপায়

স্ক্যাবিসের চিকিৎসায় ঔষধ অপরিহার্য হলেও কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি ত্বকের আরাম এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে:

  • নিম তেল: প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণে মাইট ধ্বংসে কার্যকর। দিনে ২-৩ বার আক্রান্ত স্থানে প্রয়োগ করুন।
  • নারকেল তেল: ত্বকের চুলকানি ও শুষ্কতা কমায়। সরাসরি ম্যাসাজ করুন।
  • লবণ পানি: ত্বক পরিষ্কার ও প্রদাহ কমায়। প্রতিদিন লবণ পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।
  • চা গাছের তেল: মাইট ধ্বংসে অ্যান্টিসেপটিক গুণসম্পন্ন। হালকা গরম পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করুন।

সতর্কতা: ঘরোয়া পদ্ধতি শুধু সহায়ক, চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ঔষধ সেবন জরুরি।

স্ক্যাবিসের ঝুঁকি কমানোর জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

স্ক্যাবিস পুনরায় ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কমাতে নিচের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন:

  • আক্রান্ত ব্যক্তির পোশাক, তোয়ালে ও বিছানার চাদর জীবাণুমুক্ত করুন।
  • জনাকীর্ণ জায়গায় ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখুন।
  • নিয়মিত গোসল এবং পরিষ্কার পোশাক পরুন।
  • চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।

স্ক্যাবিস রোগ নিরাময়ে কতদিন সময় লাগে?

সঠিক চিকিৎসা শুরু করার পর স্ক্যাবিস নিরাময় হতে সাধারণত ১-২ সপ্তাহ সময় লাগে। তবে, চুলকানি আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকতে পারে। চিকিৎসা সঠিকভাবে না করলে সংক্রমণ আবার ফিরে আসতে পারে।

শেষ কথা

স্ক্যাবিস একটি চুলকানিযুক্ত সংক্রামক রোগ হলেও সঠিক স্ক্যাবিস রোগের ঔষধের নাম এবং চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করলে এটি সহজেই নিরাময় সম্ভব। চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া রোগটি পুরোপুরি নির্মূল করার চাবিকাঠি। তাই, যদি আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হন, তাহলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করুন এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস অনুসরণ করুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top