ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ | ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিকার

ডেঙ্গু জ্বর একটি মশাবাহিত ভাইরাল ভাইরাসজনিত রোগ সংক্রমণ। এডিস প্রজাতির স্ত্রী মশার কামড়ে এটি হয়ে থাকে। সাধারণত এডিস এজিপ্টাই মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়।এই মশাগুলো দিনের বেলা কামড়ায় এবং বিশেষ করে ভোর ও সন্ধ্যার সময় বেশি সক্রিয় থাকে। এটি তখনই ঘটে যখন মশা একটি সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড় দেয় এবং তারপর ভাইরাস বহন করার সময় একটি অ-সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড় দেয়। চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু হয়েছে সেটি বুঝতে না পারার কারণে হাসপাতালে যেতে দেরি করছেন রোগীরা। ফলে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আসলেও অনেকেই মারা যাচ্ছেন।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা সাবেরা গুলনাহার বলেন, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হবার পর থেকে লক্ষণ দেখা দিতে পাঁচ থেকে সাত দিন সময় লাগে। এই সময়কে বলা হয় ইনকিউবেশন পিরিয়ড।

ডেঙ্গু হলে প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা কমে যেতে পারে। সুস্থ মানুষের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা ১,৫০,০০০-৪,৫০,০০০ থাকে, ডেঙ্গুতে ২০,০০০ এর নিচে নেমে গেলে ঝুঁকিপূর্ণ। ২১,০০০-৪০,০০০ হলে মাঝারি ঝুঁকি। তবে শুধু প্লেটলেট দেখে ঝুঁকি বোঝা ঠিক নয়, অন্যান্য লক্ষণ ও গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা এবং প্রচুর তরল খেলে প্লেটলেট স্বাভাবিক হবে।

কিভাবে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায়

এডিস মশা দিনের বেলা কামড়ায়। এই মশা বদ্ধ পানিতে ডিম পাড়ে, যা ৮-১০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হয়।যখন এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন ভাইরাসটি মশার দেহে চলে আসে। ডেঙ্গু মশা যখন ডেঙ্গু ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় দেওয়ার পর মশাটি যদি আরেকজন সুস্থ মানুষকে কামড় দেয়, তাহলে সুস্থ ব্যক্তিটি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে থাকে। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোন ব্যক্তিকে কামড়ালে, সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। আবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোন জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে, সেই মশাটিও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।এই জ্বর প্রতিরোধের একটি উপায় হলো, যখনই যাকে কামড়াবে, তখন তাকে একটু আলাদা রাখা, মশারির ভেতর রাখা, যত দূর সম্ভব তাকে দিনের বেলা সুরক্ষিত করে রাখা।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ

ডেঙ্গু জ্বর হল একটি মশাবাহিত ভাইরাস রোগ। ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ সাধারণত সংক্রমণের ৪-১০ দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে প্রথমবার ডেঙ্গু-তে আক্রান্ত রোগীর বিশেষ কোন উপসর্গ দেখা যায় না। শুধু অল্প কিছু ক্ষেত্রেই রোগের প্রভাব গভীর হয়। রোগীর বয়স, শারীরিক অবস্থা এবং ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন অনুসারে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ভিন্ন হয়।

104-ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উচ্চ জ্বর। এটা হঠাৎ ঘটতে পারে।ডেঙ্গু রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হলো অত্যধিক জ্বর এবং শরীরে ব্যথা। ৯৯ এবং ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর তাপমাত্রা থাকতে পারে।

ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হওয়া।

প্রচন্ড মাথাব্যথা।

রক্তে প্লাটিলেট কমে যাওয়া।

ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীর থেকে প্রস্রাবের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।

রোগীরা অনেক সময় বমি বমি ভাব অনুভব করেন এবং কিছু ক্ষেত্রে বমিও হয়ে থাকে।

শরীরের বিভিন্ন অংশে ফুসকুড়ি বা শরীরে লাল লাল ছোপ সৃষ্টি হয়।

গ্রন্থি ফুলে যাওয়া।

শরীরে ব্যথা, হাড়, জয়েন্টে ব্যথা। মাংসপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে প্রচন্ড ব্যথা।

নাক বা মাড়ি থেকে রক্তপাত। এটি বেশিরভাগই হালকা।

ত্বকে সহজে ক্ষত। কখনও কখনও, ত্বকের নীচে সূক্ষ্ম পাত্রগুলি ক্ষতের মতো দেখা দেয়। এটি কোনো আঘাত ছাড়াই ঘটতে পারে।

ক্লান্তি ও দুর্বলতা।

চোখের মণির পিছনে ব্যথা।ডেঙ্গু রোগে চোখে লালচে ভাব দেখা দিতে পারে, যা চোখে একটি তীক্ষ্ণ জ্বালা এবং অসুবিধা করতে পারে যা ডেঙ্গু জ্বরের একটি সাধারণ লক্ষণ।

ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির অত্যধিক শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে।

তবে এবারের চিত্রটা অনেকটাই ভিন্ন। দেখা যাচ্ছে জ্বরের তাপমাত্রা খুব বেশি একটা বাড়ছে না,শরীরেও তেমন ব্যথা হচ্ছে না। সাধারণত জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা হালকা দেখা যেতেও পারে। অথচ কিছুদিনের মধ্যে শরীরের অবস্থার অবনতি হয়। রোগের পালস পাওয়া যায় না।, প্রসব হয়না, প্রেসার কমে যাওয়া,কিডনি সমস্যা এমনকি রোগী অজ্ঞানও হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের ১.৫ লাখ থেকে ৪.৫ লাখ প্লাটিলেট দেখা যায়।ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের প্লাটিলেট ১ লাখ নিচে নেমে আসলে শরীরে ছোপ ছোপ দাগ, বমি, বমির সাথে রক্ত ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।

ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিকার

ডেঙ্গুর চিকিৎসার বিশেষ কোন ওষুধ বা প্রতিষেধক এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘরোয়া চিকিৎসাতেই কমে যায়।রোগের মাত্রা অতিরিক্ত ভাবে বৃদ্ধি পেলে রোগী কে হসপিটালে ভর্তি এবং ডাক্তারি নজরদারি তে রাখা একান্ত জরুরী।ডেঙ্গুর চিকিৎসা মূলত লক্ষণ ভিত্তিক হয়ে থাকে। নিম্নে কিছু প্রতিকারের উপায় উল্লেখ করা হলো :

• পর্যাপ্ত পানি পানের মাধ্যমে শরীর হাইড্রেটেড রাখা

ডেঙ্গুর কারণে রোগী ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়, তাই প্রচুর পানি, ফলের রস বা ইলেক্ট্রোলাইটযুক্ত তরল পান করা উচিত।

• পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা

বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যথাতে পানি না জমে থাকে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে

• ব্যথানাশক ওষুধ পরিহার

ডেঙ্গু জ্বরে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে রোগীর তীব্র মাথা ব্যথা ও শরীরে ব্যথা থাকে। এসময় চিকিৎসকের পরামর্শমতো শুধুমাত্র প্যারাসিটামল ব্যবহার করা উচিত। অ্যাসপিরিন এবং আইবুপ্রোফেন এড়ানো উচিত কারণ এগুলো রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায়।

• পরিপূর্ণ পোশাক পরুন

আপনার ত্বক যতটা সম্ভব ঢেকে রাখুন।এছাড়াও, সুতি, লিনেন বা ডেনিমের মতো মোটা কাপড় পরার চেষ্টা করুন। এতে মশার কামড়ের ঝুঁকি কমে যাবে।

• পর্যাপ্ত বিশ্রাম

রোগীর শারীরিক শক্তি কমে যাওয়ার কারণে তাকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে হবে।রোগীকে সবসময় মশারির ভেতর বিশ্রাম নিতে হবে।

• প্লেটলেট মনিটরিং

প্লেটলেট কমে যাওয়া ডেঙ্গুর গুরুতর লক্ষণ হতে পারে, তাই এটি নিয়মিত মনিটরিং করা প্রয়োজন।

ডেঙ্গু জ্বর একটি সাধারণ রোগ। কিন্তু অবহেলা করলে এই রোগ মারাত্মক হতে পারে। শহরাঞ্চলে এর প্রকোপ বেশি।ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা সঠিকভাবে না নিলে এটি মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে তাই নগরবাসীকে আরেকটু সজাগ ও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে যাদের ডেঙ্গু হয়েছে তাদের অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে। কারন দ্বিতীয় ডেঙ্গু সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। তাই উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ডেঙ্গু হলে কি খাবার খাওয়া যাবে না

ডেঙ্গু জ্বরে কিছু খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো। যেমন, ফাস্ট ফুড, ভাজাপোড়া, কাঁচা সবজি (যেমন সালাদ), অতিরিক্ত শক্ত খাবার ইত্যাদি। কারণ, এই খাবারগুলো হজমে সমস্যা করতে পারে এবং ডেঙ্গু জ্বরে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে। এছাড়াও, কড়া দুধ-চা, কফি, এনার্জি ড্রিঙ্ক পরিহার করা উচিত। কারণ, এগুলো শুধু হজমের বেঘাত ঘটায় না, তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে ও বাধা দেয়।

শেষ কথা

আজকে আলোচনায় আমরা ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করেছি। ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক সতর্কীকরণ লক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা দ্রুত চিকিৎসা এবং গুরুতর জটিলতা প্রতিরোধের জন্য অপরিহার্য। যদি আমাদের এই পোস্ট আপনাদের কাছে ভালো লেগে থাকে।  তাহলে অবশ্যই আপনার আশেপাশের ব্যক্তিদের কে এই পোস্ট শেয়ার করে তাদেরকে জ্বর কমানোর ওষুধ সম্পর্কে জানিয়ে দিন।  ধন্যবাদ

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top